হাসনাত আবদুল হাই
কয়েকদিন আগে টেলিভিশনের এক অনুষ্ঠানে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার কয়েকজন কৃষককে দেখালো এবং তাদের কথা শোনালো। তারা একটা খালের উপর রাবারের তৈরি ড্যাম (বাঁধ) দেখিয়ে বললো, সেই বাঁধ দিয়ে শুকনো মৌসুমে পানি আটকে রেখে দু’পাশের জমিতে সেচের জন্য পানি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। এর আগে শীতকালে দুপাশের জমিতে সেচের জন্য পানি দেওয়া সম্ভব ছিল না, তখন জমি পতিত পড়ে থাকতো, কোনো ফসল হতো না।
আমি সেই রাবার ড্যাম নিজের চোখে দেখেছি, আজ থেকে বার বছর আগে। এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী আমাকে চকরিয়ায় নিজে সেই ড্যাম দেখিয়ে তার পরিচালনা ও ব্যবহার ব্যাখ্যা করেছিলেন। রাবার ড্যামের প্রবর্তন তিনিই প্রথম করেন, অবশ্য এর উদ্ভাবক তিনি ছিলেন না। চীনে এক সরকারি সফরে গিয়ে এমন ড্যাম দেখে বাংলাদেশে ফিরে কক্সবাজারের চকরিয়ায় একটি স্থাপন করে এর কার্যকারিতা প্রদর্শন করেছিলেন সবাইকে। এটি সফল হয়েছিল এবং জনপ্রিয় হয়েছিল। প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে তার বহুমুখী কর্মতৎপরতা ও সফল উদ্যোগের এটি একটি দৃষ্টান্ত।
এমন দৃষ্টান্ত আরো আছে। যেমন কক্সবাজারেই স্বল্প খরচে সাইক্লোন প্রতিহত করে টিকে থাকার উপযোগী বাড়ি তৈরি। ফরিদপুরের মাদারীপুরে জৈব-চুল্লির সফল প্রয়োগ। সব নতুন উদ্যোগ যে তার নিজের উদ্ভাবন ছিল তা নয়। তিনি যখন যেখানে যেতেন, দেশে অথবা বিদেশে, চোখ-কান খোলা রাখতেন। অনুকরণীয়, প্রয়োগযোগ্য কিছু দেখলেই নমুনা এনে ব্যবহার করে অন্যদের দেখাতেন। যদি কোনো অভিধায় ভূষিত করতে হয়, তাহলে তাকে বলা যায় ‘ব্যবহারিক বৈজ্ঞানিক’।
কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের জীবনের প্রধান অবদান হলো মন্ত্রণালয়ের একটি শাখাকে এলজিইডি নামে স্বতন্ত্র দপ্তরে রূপান্তর করা এবং সেই দপ্তরের জন্য একটি বিশাল ভবন নির্মাণ। লাল ফিতার দৌরাত্ম্যে যেখানে প্রায় সব সিদ্ধান্ত ধীর গতিতে গৃহীত হয়, সেখানে একজন কর্মকর্তার দায়িত্বকালে এমন দুটি বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করা প্রায় অকল্পনীয়। তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন।
কর্মবীর এবং করিৎকর্মা বলেই তিনি এটি সম্ভব করেছিলেন। দক্ষতা এবং কৌশল দিয়ে তাকে পথ চলতে হয়েছে, কারণ তার কাজের বিরোধিতা করতে অনেকেই প্রস্তুত ছিল। তিনি ছিলেন এমন একজন, যার কাছে ব্যর্থতা, পরাজয় বা পিছু হটে আসা ছিল অপরিচিত। যা তার মাথায় আসতো, তা শেষ না করা পর্যন্ত তিনি থামতেন না। এলজিইডির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
এলজিইডিকে স্বতন্ত্র দপ্তর হিসেবে গঠন করেই তিনি ক্ষান্ত হননি। এর কাজের পরিধি অতি দ্রুত বৃদ্ধি করেছেন। নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। ফলে বিভিন্ন দাতা সংস্থাই তার প্রতিষ্ঠানের কাছে অর্থ সহায়তা নিয়ে এসেছে।
এই প্রকল্পগুলোর মধ্যে কিছু কিছু নির্ধারিত কর্মসূচির মধ্যে না পড়লেও তিনি কখনো অস্বীকার করেননি। মিউনিসিপ্যালিটির উন্নয়ন থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র পানি উন্নয়ন প্রকল্প – সবক্ষেত্রেই তিনি উদ্যোগ নিয়েছেন। অনেক মন্ত্রণালয় বা কর্তৃপক্ষ এতে অসন্তুষ্ট হয়েছিল, কিন্তু সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের আস্থাভাজন হওয়ায় তিনি হতোদ্যম হননি।
যেমন, ধানমন্ডি লেক উন্নয়ন প্রকল্প। এটি সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন ছিল, কিন্তু দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই প্রকল্পের দায়িত্ব তাকেই দেওয়া হয়। কমলাপুর ফ্লাইওভারও এলজিইডির করার কথা ছিল না, কিন্তু এটি সফলভাবে সম্পন্ন করে এলজিইডিই।
দেশের উন্নয়নে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে এলজিইডির সবচেয়ে বড় অবদান হলো রাস্তা ও সেতু নির্মাণ। ভাঙাচোরা, আঁকাবাঁকা রাস্তার স্থলে আজ যে আধুনিক সড়ক নেটওয়ার্ক দেখা যায়, তার পেছনে রয়েছে এলজিইডি।
এলজিইডি বলতেই বোঝাতো কামরুল ইসলাম সিদ্দিককে। তিনি দ্রুতগতিতে গ্রামাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করেছেন। গ্রোথ সেন্টার বা উন্নয়ন কেন্দ্রের ধারণা তার মাথা থেকেই এসেছে। সম্ভাবনাময় হাট-বাজারকে আধুনিক করে গড়ে তুলে তিনি বাজারজাতকরণ এবং শিল্পোন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে এটি সফল হয়েছিল।
তিনি প্রথম ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণা দেন – একথা অত্যুক্তি হবে না। প্রতিটি উপজেলায় কম্পিউটার স্থাপন করে তিনি জিপিএম-এর মাধ্যমে সমস্ত দেশকে ডিজিটাল নেটওয়ার্কের আওতায় এনেছিলেন। তখন অন্য কোনো সরকারি সংস্থা এমন অগ্রগামী চিন্তা করতে পারেনি।
তিনি বিশ্বাস করতেন দক্ষ জনশক্তিই এলজিইডির সাফল্যের মূল শক্তি। এলজিইডির কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য তিনি নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন, যা দেশ-বিদেশে গ্রহণ করার সুযোগ ছিল।
তিনি ছিলেন জ্ঞানপিপাসু। এত ব্যস্ততার মাঝেও বই পড়তে ভালোবাসতেন। বিদেশ থেকে বই কিনতেন এবং সহকর্মীদের পড়তে দিতেন। তার জ্ঞানের পরিধি ছিল বিশাল। নতুন চিন্তা ও উদ্ভাবনের পেছনে ছিল তার প্রচুর পড়াশোনা।
তিনি ছিলেন অমায়িক ও সদাহাস্য ব্যক্তিত্ব। কাজের ক্ষেত্রে কঠোর ছিলেন, কিন্তু এটি ছিল স্নেহ ও ভালোবাসার অংশ। কর্মবীর এবং স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে তার মৃত্যু দেশের জন্য বিরাট ক্ষতি। তিনি দেশকে আরও অনেক কিছু দিতে পারতেন।
কামরুল ইসলাম সিদ্দিক ক্ষণজন্মা পুরুষ ছিলেন। তার জীবন ও কর্ম অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।