ড. প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরী
কামরুল ইসলাম সিদ্দিক ১৯৬২ সালে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবর্ষে ভর্তি হন-আমি তখন চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। ১৯৬৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে আমি পুরকৌশল বিভাগে লেকচারার হিসাবে শিক্ষকতা জীবন শুরু করি; আমার উপর দায়িত্ব পড়ে মূলত তৃতীয়বর্ষে Structure বিষয়ে পড়ানো, তবে কোন শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলে বিভাগীয় প্রধান আমাকে দ্বিতীয়বর্ষে অধ্যয়নরত কামরুলদের ক্লাসেও মাঝে মাঝে পাঠাতেন। সেই হিসাবে কামরুল আমাকে সারাজীবন শিক্ষক হিসাবে সম্মান দেখিয়েছেন।
১৯৬৬ সালে পুরকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর কামরুল Works Program-এ জেলা পর্যায়ে চাকুরি নিয়ে ঢাকার বাইরে চলে যান-তাই বহু বছর তার সাথে যোগাযোগ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ শেষে তিনি ৭০-এর দশকে আবার প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন URP-এর স্নাতকোত্তর ছাত্র হিসাবে। তখন ও মাঝে মাঝে দেখা হত।
১৯৮৪ সালে Local Government Engineering Bureau প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি এর Engineer Advisor হিসাবে বিভিন্ন সময়ে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগে নানা কাজে আমার কাছে আসতেন। তাঁর মধ্যে একটা কাজ ছিল Earthwork Manual প্রণয়ন করা; আরেকটি ছিল Bridge Design Manual তৈরি করা-এই দুটি Manual তৈরির সম্পূর্ণ দায়িত্ব USAID অর্পণ করেছিল বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগে। সেই সুবাদে কামরুলের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়। LGEB-কে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ হিসাবে LGED-তে উন্নীত করার পিছনে ছিল কামরুলের নিরলস প্রচেষ্টা।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে যে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস আঘাত হানে, তাতে প্রায় ১,৩৮,০০০ লোক প্রাণ হারান এবং অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর পরপরই ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্যোগে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করে।
আমাদের সভায় যখন ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র ডিজাইন ও নির্মাণের ব্যাপারে আলোচনা করছিলাম, তখন কামরুল উপস্থিত ছিলেন এবং Cyclone Shelter-এর কয়েকটি ডিজাইন উপস্থাপন করেন। LGEB-এ ধরনের কাজে জড়িত ছিল না, কিন্তু তাঁরই উদ্যোগে অত্যন্ত অল্প সময়ে estimated cost সহ সম্ভাব্য ডিজাইন তৈরি করেন। এর ফলে LGED সরকারের ও দাতা সংস্থার অর্থায়নে উপকূল অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিরাট অবদান রাখতে সক্ষম হয়।
১৯৯৬ সালে আমাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব নিতে হয়। প্রধান দায়িত্ব ছিল ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মনিটরিংয়ের জন্য আমি GIS প্রযুক্তি ব্যবহারের পরামর্শ দিই।
আমি জানতাম, কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের ব্যক্তিগত আগ্রহে LGED তখন GIS ব্যবহার করে সমগ্র বাংলাদেশের উপজেলাভিত্তিক মানচিত্র তৈরির কাজ সম্পন্ন করেছে। তিনি দ্রুত GIS প্রকৌশলীদের নিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য একটি কার্যকরী GIS-ভিত্তিক পদ্ধতি তৈরি করেন, যা পুলিশের জন্য বড় সহায়ক হয়।
সরকারি দায়িত্ব ছাড়াও তিনি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন। ২০০৪ সালে সভাপতি নির্বাচিত হয়ে তিনি সংগঠনের কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করেন। ২০১৩ সালে তাকে মরণোত্তর IEB Gold Medal প্রদান করা হয়।
কোনো নতুন প্রযুক্তি এলেই তিনি তা LGED-এ কীভাবে প্রয়োগ করা যায় তা ভাবতেন। ১৯৯০-এর দশকে PC আমদানি শুরু হতেই তিনি LGEB-তে কম্পিউটার ব্যবহার শুরু করেন। ১৯৯৬ সালে Internet সংযোগ আসার পরপরই LGED-এর Website তৈরির উদ্যোগ নেন।
ফ্যাক্স মেশিন ব্যবহারে তিনি সব জেলার কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষিত করতে বলেন। একবার তিনি একটি অফিসে গিয়ে দেখেন, মেশিন চালু করতে কেউ জানে না। তখনই তিনি কর্মকর্তাকে ফ্যাক্স চালু করতে বলেন এবং কেন নির্দেশ পালন করা হয়নি, তার কৈফিয়ত তলব করেন।
২০০৪ সালে ঢাকার Strategic Transport Plan (STP) প্রণয়নে ঢাকা Transport Coordination Board-এর নির্বাহী পরিচালক হিসেবে তিনি Steering Committee গঠনের উদ্যোগ নেন। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের আগেই তাকে অন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়, কিন্তু তার সময়ে ঢাকার যানবাহন অবকাঠামো উন্নয়ন গতিশীল হয়।
তিনি LGED-কে একটি বৃহৎ ও dynamic প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলেন। তরুণ প্রকৌশলীদের উন্নত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশি স্কলারশিপের ব্যবস্থা করতেন।
বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে LGED-কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিত। এমনকি, অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশে LGED-এর মডেল প্রয়োগ করতে বহু দেশ থেকে প্রতিনিধি এসেছিলেন তার পরামর্শ নিতে।
গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন যে দারিদ্র্য বিমোচনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে, তা LGED-এর কাজ প্রমাণ করেছে। এর নেতৃত্বে দীর্ঘসময় থাকার কারণে দেশবাসী তাকে স্মরণ রাখবে।
সরকারি চাকরি শেষে দেশি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। মৃত্যুর আগের দিন তিনি আমাকে ই-মেইল করেন STP সম্পর্কে সর্বশেষ অগ্রগতি জানতে এবং সুপারিশ পাঠাতে। ছুটিতে গিয়েও তিনি দেশের সমস্যা নিয়ে ভাবতেন।
তার অকাল মৃত্যুতে আমরা একজন Visionary Leader-এর অবদান থেকে বঞ্চিত হলাম।