— ড. এটিএম শামসুল হুদা
উন্নয়ন কর্মকান্ডের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের ছিল অবাধ ও সাহসী বিচরণ। যেখানেই তাঁর হাতের স্পর্শ লেগেছে সেখানেই তিনি তাঁর কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। আমি তাঁর একজন গুণমুগ্ধ সহকর্মী - তাঁর কর্মময় জীবনের শুধুমাত্র একটি দিক নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করব। তা হলো, প্রতিষ্ঠান নির্মাণে কর্মজীবনের শুরু থেকে তাঁর প্রচেষ্টা এবং শত বাধা-বিপত্তির মধ্যেও তা সফলতার সাথে প্রতিষ্ঠা। তাঁর অন্য সফল কাজের মধ্যে এটি একটি অনন্য অবদান যা তাঁকে স্থানীয় সরকার পরিমণ্ডলে চিরস্মরণীয় করে রাখবে।
আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্রের আবশ্যকীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের জন্য সৎ, দক্ষ ও যোগ্য কর্মীবাহিনী সমন্বয়ে গঠিত বহু প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হয়। দেশের জনগণকে কাঙ্ক্ষিত সেবাপ্রদান, দারিদ্র বিমোচন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সর্বোপরি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য গতিশীল, কর্মক্ষম ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের কোন বিকল্প নাই।
ভারত উপমহাদেশে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী উপনিবেশ কায়েম করলেও জনগণকে সীমিত আকারে সেবা প্রদানের লক্ষ্যে প্রশাসনিক উত্তরাধিকার হিসাবে বেশ কিছু ভালো প্রতিষ্ঠান রেখে যায়। পাকিস্তান আমলে বিভিন্ন জনের ভিন্ন ভিন্ন বিবেচনায় কিছু কিছু পরিবর্তন করা হলেও মূল কাঠামো ও এগুলির কার্যক্রম মোটামুটি অক্ষুণ্ন রাখা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অবশ্য এ অবস্থা আর থাকেনি। স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে এইসব প্রতিষ্ঠানের ধ্যান ধারণায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটানো হয়। ফলে এগুলোর অবকাঠামোও আর অক্ষুণ্ন থাকে না। সর্বোপরি, এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতির প্রকল্প প্রস্তাব এদের কার্যকারিতা বহুলাংশে বিনষ্ট করে এবং জনগণের একাংশের আস্থা ও আশার এইসব প্রতিষ্ঠান তাদের অনাস্থা ও হতাশার মূর্ত প্রতীকে পর্যবসিত হয়।
দেশের শত বছরের অধিক সময়কালের গৌরবোজ্জ্বল প্রতিষ্ঠানসমূহের যখন এরকম করুণ অবস্থা, এসময় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণকে সেবা প্রদানের জন্য একটি দক্ষ, দায়িত্ববান ও গণমুখি প্রতিষ্ঠান নির্মাণের স্বপ্ন শুধু দুঃসাহসিক কাজই নয় বটে। কিন্তু এই কাজটিই অত্যন্ত সততা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করে কামরুল ইসলাম সিদ্দিক স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করে তাঁর অসাধারণ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন।
স্বাধীন হওয়ার পর একটি প্রাদেশিক সরকার থেকে যখন বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়, তখন রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে এবং সরকারের ক্রমবর্ধমান কাজের পরিধির সাথে তাল মিলিয়ে বহু নতুন নতুন দপ্তর, অধিদপ্তর, বিভাগ কিংবা মন্ত্রণালয়ের উদ্ভব হয়। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর যা জনগণের কাছে ‘এলজিইডি’ নামে সমধিক পরিচিত, সেটিরও উদ্ভব এই একই ধারাবাহিকতার সূত্র ধরে। কিন্তু কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের চিন্তার স্পষ্টতা, লক্ষ্য নির্ধারণে অবিচল নিষ্ঠা ও সততা এবং নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানসমূহ অর্জন ও ব্যবহারের নব নব পদ্ধতি উদ্ভাবন তাঁর প্রিয় প্রতিষ্ঠানটিকে একটি অনন্য সংস্থায় পরিণত ও পরিচিত প্রদান করেছে। সরকারের বিভিন্ন কাজের সময় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত যারা তারা সকলেই এলজিইডির এই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য প্রতিনিয়ত লক্ষ করে থাকেন।
১৯৬৭ সালে ক্ষুদ্র পরিসরে কর্মজীবন শুরু করে ওয়ার্কস প্রোগ্রাম নামীয় একটি উন্নয়ন প্রকল্পকে তিনি বিশালায়তন এলজিইডিতে রূপান্তর করেন। উপজেলা পর্যন্ত এই অধিদপ্তরের সরব উপস্থিতি আমরা সবাই লক্ষ করে থাকি। এই প্রতিষ্ঠানটিকে দক্ষ করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি একটি কর্মীবাহিনীও গঠন করেন এবং তাদের কাছ থেকে মানসম্পন্ন কাজ পাওয়ার প্রত্যাশায় তাদের বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেন। সাথে সাথে প্রয়োজনীয় দপ্তর ও আবাসিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দিকেও তাঁর ছিল প্রখর দৃষ্টি। ঢাকার আগারগাঁওয়ে তিনিই এলজিইডির আধুনিক প্রধান কার্যালয়ের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন।
যে কোন সার্থক প্রতিষ্ঠানে যেমন অগ্রসর চিন্তাচেতনার অব্যাহত চর্চা ও প্রয়োগের প্রয়োজন, তেমনি এর প্রয়োজন একটি দৃশ্যমান অবয়বের যা সফল চিন্তা চেতনাকে ধারণ, পরিপোষণ ও রক্ষণে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। কামরুল ইসলাম সিদ্দিক এলজিইডির এই উভয় অনুষঙ্গ-কাঠামো ও প্রক্রিয়াকে সমান গুরুত্ব দিয়েছেন।
প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণকে সেবা প্রদানের লক্ষ্যে কামরুল ইসলাম সিদ্দিক বহু নতুন নতুন পদ্ধতি ও প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও প্রয়োগ করেছেন। এখানে আমি শুধু দুটি উদ্যোগের কথা উল্লেখ করব। প্রথম উদ্যোগটি ছিল গ্রাম অঞ্চলে ক্ষুদ্র চাষীদের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পের প্রবর্তন। পানি উন্নয়ন বোর্ড বৃহৎ ও মাঝারি প্রকল্প বাস্তবায়নে তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে - ক্ষুদ্র প্রকল্প নিয়ে তারা খুব একটা চিন্তা ভাবনা করে না। এই অভাবটা দূর করার লক্ষ্যে কামরুল ইসলাম সিদ্দিক পানি উন্নয়ন বোর্ডের আইনেই ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প (এক হাজার হেক্টর কিংবা তদনিম্ন কমান্ড এরিয়া সম্বলিত) বাস্তবায়নে আইনগত অধিকার এলজিইডিকে প্রদান করা হয়।
দ্বিতীয় উদ্যোগটি ছিল ক্ষুদ্র সেচ ধারণার আওতায় ছোট ছোট নদীতে রাবার ড্যাম স্থাপন করে সেচসুবিধা প্রদান। এখানেও বহু বাধা ও সমালোচনার সম্মুখীন হন তিনি। কিন্তু শেষে তাঁর দূরদৃষ্টি ও সাহসিকতাই জয় হয়। রাবার ড্যাম এখন বাংলাদেশে একটি পরিচিত ও ব্যবহৃত প্রযুক্তি।
কামরুল ইসলাম সিদ্দিক অনেক প্রতিষ্ঠানের সাথেই কাজ করেছেন কিন্তু সার্থকভাবে নির্মাণ করে গেছেন একটি প্রতিষ্ঠান ‘স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর’ যার উত্তরাধিকার তাঁর স্মৃতিকে চির উজ্জ্বল করে রাখবে।